অধ্যায় ২৩: প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দের ব্যবহারের কৌশল

ভূমিকা

বাংলা ভাষায় একটি শব্দের পরিবর্তে আরেকটি শব্দ ব্যবহার করা অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয়। কখনো ভাষাকে সমৃদ্ধ ও রুচিশীল করতে, কখনো কবিতা বা সাহিত্যকে অলংকারময় করে তুলতে, আবার কখনো একই শব্দ বারবার ব্যবহারের একঘেয়েমি দূর করতে প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হয়।

প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দ শুধু ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং বাক্যের অর্থ স্পষ্ট করা, লেখার মান উন্নত করা ও সাহিত্যিক গুণ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অধ্যায়ে প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দের সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগের কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।


প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দের সংজ্ঞা

🔹 প্রতিশব্দ: একই অর্থ বহন করে এমন ভিন্ন ভিন্ন শব্দকে প্রতিশব্দ বলা হয়।
🔹 সমার্থক শব্দ: সমার্থক শব্দ প্রতিশব্দেরই আরেকটি রূপ, যা একই অর্থ প্রকাশ করে, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে।

📌 উদাহরণ:

  • সূর্য – রবি, দিবাকর, ভানু, মিহির
  • জল – পানি, বারি, নীর, তোয়
  • আনন্দ – সুখ, উল্লাস, হর্ষ, আমোদ

🔹 প্রতিশব্দ এবং সমার্থক শব্দের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রতিশব্দ প্রায় সব সময় একই অর্থ বহন করে, কিন্তু সমার্থক শব্দের প্রয়োগ নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।


প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা

ভাষাকে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করা – একই শব্দ বারবার ব্যবহারের পরিবর্তে প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে ভাষা সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়।
একঘেয়েমি দূর করা – রচনায় বা বক্তৃতায় বারবার একই শব্দ ব্যবহার বিরক্তিকর হতে পারে, তাই সমার্থক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা যায়।
কাব্যিক ও সাহিত্যিক অলংকার বৃদ্ধির জন্য – সাহিত্যিক রচনা, কবিতা, নাটক ও উপন্যাসে শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগের জন্য প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়।
বাক্যের ভাব স্পষ্ট করা – অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশব্দের সাহায্যে বাক্যের ভাব আরও পরিষ্কার ও যুক্তিসংগত করা যায়।
শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা – বেশি বেশি প্রতিশব্দ জানার মাধ্যমে বাংলা ভাষার জ্ঞানের প্রসার ঘটে।


প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দ ব্যবহারের কৌশল

📌 ১. বাক্যের অর্থ ও প্রেক্ষাপট বুঝে প্রতিশব্দ নির্বাচন করুন

প্রতিটি প্রতিশব্দের ব্যবহার ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। যেমন:

“চন্দ্র” শব্দের প্রতিশব্দ – শশী, ইন্দু, নিশাকর, হিমাংশু, রাজনীকর।
“চন্দ্রগ্রহণ” শব্দের প্রতিশব্দ – ইন্দুগ্রাস, শশিগ্রাস।

❌ কিন্তু “চন্দ্রগ্রহণ” শব্দের জায়গায় “শশী” বা “হিমাংশু” বসালে তা ভুল হয়ে যাবে। তাই, বাক্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিলিয়ে শব্দ নির্বাচন করতে হবে।

📌 ২. ভাষার সৌন্দর্য ও রুচি অনুযায়ী প্রতিশব্দ ব্যবহার করুন

সাধারণ কথোপকথনে বা প্রাত্যহিক লেখায় কঠিন প্রতিশব্দ ব্যবহার না করাই ভালো। যেমন:

“জল” – সাধারণ ব্যবহারের জন্য “পানি” শব্দটি বেশি উপযোগী।
“সূর্য” – সাধারণ বাক্যে “সূর্য” ব্যবহার করাই ভালো, কিন্তু কবিতায় “মিহির” বা “রবি” শব্দটি বেশি কাব্যিক শোনায়।

📌 ৩. সাহিত্য ও আনুষ্ঠানিক লেখায় উপযুক্ত সমার্থক শব্দ বেছে নিন

সাহিত্যিক রচনায় প্রতিশব্দের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। যেমন:

“আকাশ” – নীলাম্বর, গগন, নভ
“বিদ্যুৎ” – চপলা, দুরন্ত, চমক, তড়িৎ

📌 ৪. শব্দের ব্যঞ্জনা ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন

সব প্রতিশব্দ সব জায়গায় প্রযোজ্য নয়, কারণ কিছু শব্দ অনুভূতির পরিবর্তন ঘটায়। যেমন:

“মৃত্যু” শব্দের প্রতিশব্দ: পরলোকগমন, দেহত্যাগ, মহাপ্রস্থান, প্রয়াণ, অন্তিমযাত্রা।
✔ তবে, কারও প্রয়াণের ক্ষেত্রে “মহাপ্রস্থান” শব্দটি বেশি শ্রদ্ধাসূচক মনে হতে পারে।

📌 ৫. পরিবেশ ও শ্রোতাপ্রেক্ষিত অনুযায়ী শব্দ নির্বাচন করুন

কিছু প্রতিশব্দ খুবই আনুষ্ঠানিক বা কাব্যিক, যা দৈনন্দিন ভাষায় ব্যবহারের উপযুক্ত নয়।

“শ্রদ্ধা” শব্দের প্রতিশব্দ – সম্ভ্রম, ভক্তি, সম্মান।
✔ সাধারণ ভাষায় “শ্রদ্ধা” বলা যায়, তবে কবিতায় “সম্ভ্রম” শব্দটি মানানসই হবে।

📌 ৬. প্রতিশব্দের ব্যবহারে অতিরিক্ত জটিলতা এড়িয়ে চলুন

ভুল প্রয়োগ:

  • “আমার প্রস্রবণ পিপাসা পেয়েছে।” (ভুল)
  • “আমার তৃষ্ণা পেয়েছে।” (সঠিক)

অতিরিক্ত কঠিন শব্দ প্রয়োগ:

  • “সূর্য এখন হিমাংশুপ্রভা ছড়াচ্ছে।” (অপ্রচলিত)
  • “সূর্য এখন সোনালি আলো ছড়াচ্ছে।” (সহজ ও সাবলীল)

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও তাদের প্রতিশব্দ

📌 মানুষের সাথে সম্পর্কিত শব্দ

  • জ্ঞান – বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা
  • শিক্ষা – বিদ্যা, জ্ঞানার্জন, অধ্যয়ন
  • প্রেম – ভালোবাসা, অনুরাগ, আসক্তি
  • কষ্ট – যন্ত্রণা, দুঃখ, ক্লেশ, বেদনা
  • সুখ – আনন্দ, উল্লাস, হর্ষ

📌 প্রকৃতি সম্পর্কিত শব্দ

  • বাতাস – সমীর, পবন, মন্দার
  • নদী – প্রবাহ, স্রোতস্বিনী, তরঙ্গিণী
  • গাছ – তরু, বৃক্ষ, উদ্ভিদ
  • আকাশ – গগন, নভ, নীলাম্বর

📌 সময় সম্পর্কিত শব্দ

  • দিন – দিবস, বেলা, আলো
  • রাত – নিশা, যামিনী, রাত্রী
  • কাল – সময়, যুগ, মুহূর্ত

📌 বিভিন্ন প্রতিশব্দ ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ বাক্যে
তিনি বিদ্যাশক্তিতে অনন্য (জ্ঞান, বিদ্যা, মেধা)।
গগনে মেঘের আনাগোনা চলছে (আকাশ, নভ, নীলাম্বর)।
তার হৃদয় ভালোবাসায় ভরে গেছে (প্রেম, অনুরাগ, আসক্তি)।


উপসংহার

প্রতিশব্দ ও সমার্থক শব্দ ব্যবহার করলে ভাষার বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়, লেখার গুণগত মান উন্নত হয়, আর বাক্যের অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে, প্রতিশব্দ ব্যবহারের সময় বাক্যের ভাব, পরিবেশ ও প্রসঙ্গ বুঝে শব্দ নির্বাচন করাই শ্রেয়।

📌 সঠিক প্রতিশব্দ নির্বাচনের জন্য পাঠ্যপুস্তক, অভিধান ও সাহিত্যচর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য নিয়মিত নতুন শব্দ শেখার ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।