অধ্যায় ২০: অপপ্রয়োগ ও ভাষাগত ত্রুটি সংশোধন

অপপ্রয়োগ ও ভাষাগত ত্রুটি সংশোধন

বাংলা ভাষার শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ব্যবহার নিশ্চিত করতে অপপ্রয়োগ ও ভাষাগত ত্রুটি পরিহার করা জরুরি। অনেক সময় আমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে শব্দ, বাক্য বা ব্যাকরণের ভুল ব্যবহার করি, যা অর্থের অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থকতা বা ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে। এই অধ্যায়ে ভাষাগত অপপ্রয়োগের সংজ্ঞা, কারণ, ধরন এবং সংশোধনের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।


অপপ্রয়োগের সংজ্ঞা

অপপ্রয়োগ বলতে বোঝায় ভুলভাবে শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার, যা প্রকৃত অর্থের বিকৃতি ঘটায় বা ভাষার শুদ্ধতা নষ্ট করে।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: সে আমাকে একটা উপহার দিয়েছে, যেটা খুব সুন্দর।
🔹 সঠিক: সে আমাকে একটা খুব সুন্দর উপহার দিয়েছে।

🔹 ভুল: এই কাজ সম্পন্ন করা দরকার।
🔹 সঠিক: এই কাজ করা দরকার।

🔹 ভুল: আমার মনে হয় যে, আমি ঠিক বলেছি।
🔹 সঠিক: আমার মনে হয়, আমি ঠিক বলেছি।


ভাষাগত অপপ্রয়োগের কারণ

১. অনভ্যাসগত ভুল:

  • বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেক সময় ভুলভাবে শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা হয়।

২. কথ্য ভাষার প্রভাব:

  • কথ্য ভাষার ভুল ব্যবহার অনেক সময় লিখিত ভাষাতেও প্রবেশ করে, যা ভাষার শুদ্ধতা নষ্ট করে।

৩. অন্য ভাষার প্রভাব:

  • ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার শব্দ বা বাক্য গঠন পদ্ধতির প্রভাব বাংলা ভাষায় ভুলভাবে সংযোজিত হয়।

৪. আঞ্চলিকতার প্রভাব:

  • বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাগত পার্থক্যের কারণে অনেক সময় শব্দ ও বাক্যের অপপ্রয়োগ ঘটে।

৫. অপর্যাপ্ত পড়াশোনা ও অনুশীলনের অভাব:

  • শুদ্ধ বাংলা ভাষার নিয়ম চর্চার অভাব থাকলে ভুল ব্যাকরণ ও শব্দগঠন তৈরি হয়।

ভাষাগত ত্রুটির প্রকারভেদ ও সংশোধন

📌 ১. শব্দের অপপ্রয়োগ:

  • ভুলভাবে শব্দ ব্যবহারের ফলে অর্থের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: সে খুব সুখী জীবনযাপন করছে।
🔹 সঠিক: সে খুব সুখে জীবনযাপন করছে।

🔹 ভুল: আমি তোমার সাহায্যের প্রত্যাশা করি।
🔹 সঠিক: আমি তোমার সাহায্য আশা করি।


📌 ২. শব্দ অপ্রয়োজনীয়ভাবে পুনরাবৃত্তি:

  • একই ধরনের শব্দ একাধিকবার ব্যবহৃত হলে বাক্য ভারী ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: আমি নিজে আমার হাত দিয়ে কাজটি করলাম।
🔹 সঠিক: আমি নিজে কাজটি করলাম।

🔹 ভুল: সে তার নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে।
🔹 সঠিক: সে তার বাড়িতে ফিরে গেছে।


📌 ৩. বিদেশি শব্দের অপপ্রয়োগ:

  • বাংলা ভাষার পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহারে ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হয়।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: সে খুব স্মার্ট ছেলে।
🔹 সঠিক: সে খুব চৌকস ছেলে।

🔹 ভুল: আমি তোমার সাপোর্ট চাই।
🔹 সঠিক: আমি তোমার সমর্থন চাই।


📌 ৪. অতিরিক্ত শব্দের সংযোজন:

  • অনেক সময় অনর্থক শব্দ ব্যবহারের কারণে বাক্য জটিল হয়ে যায়।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো যে, এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।
🔹 সঠিক: আমার মতামত হলো, এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।

🔹 ভুল: প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ম মেনে চলা উচিত।
🔹 সঠিক: প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর নিয়ম মেনে চলা উচিত।


📌 ৫. ইংরেজি বাক্যগঠনের অনুসরণ:

  • অনেক সময় বাংলা ভাষায় ইংরেজি বাক্য গঠনের ধাঁচ অনুসরণ করা হয়, যা ভাষাগত ত্রুটি তৈরি করে।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: আমি একটি সিদ্ধান্তে এসেছি। (I have come to a decision.)
🔹 সঠিক: আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

🔹 ভুল: সে পরীক্ষায় ভালো করেছে। (He has done well in the exam.)
🔹 সঠিক: সে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে।


📌 ৬. সর্বনামের ভুল ব্যবহার:

  • বাক্যে সর্বনামের ভুল ব্যবহার করলে অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: শিক্ষক ছাত্রকে বলল, সে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।
🔹 সঠিক: শিক্ষক ছাত্রকে বলল, তুমি পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।

🔹 ভুল: আমার মনে হয় যে, তুমি সে কথা বলোনি।
🔹 সঠিক: আমার মনে হয়, তুমি ওই কথা বলোনি।


📌 ৭. ক্রিয়াপদের ভুল ব্যবহার:

  • বাংলা ক্রিয়াপদের ভুল ব্যবহারে বাক্যের অর্থ পরিবর্তন হতে পারে।

উদাহরণ:
🔹 ভুল: তুমি কোথায় ছিল?
🔹 সঠিক: তুমি কোথায় ছিলে?

🔹 ভুল: সে বইটি পড়া শেষ করেছে।
🔹 সঠিক: সে বইটি পড়ে শেষ করেছে।


ভাষাগত ত্রুটি সংশোধনের উপায়

১. বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম চর্চা করা।
২. শুদ্ধ বাংলা লেখা ও বলার অনুশীলন করা।
৩. সাহিত্য ও সংবাদপত্র পড়ে ভাষার শুদ্ধ রীতি রপ্ত করা।
৪. ভুল ত্রুটি ধরতে পারলে নিজেই সংশোধন করার অভ্যাস গড়ে তোলা।
৫. বিদেশি শব্দ বা ভাষার অযথা প্রভাব এড়িয়ে চলা।
৬. কথ্য ও লেখ্য ভাষার ব্যবধান বুঝে সঠিক ভাষারীতি অনুসরণ করা।


উপসংহার

বাংলা ভাষার শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ব্যবহারের জন্য অপপ্রয়োগ ও ভাষাগত ত্রুটি সংশোধন করা জরুরি।
ভুল উচ্চারণ, শব্দের অপপ্রয়োগ, বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ও বাক্যগঠনের ভুল এড়িয়ে চললে ভাষার শুদ্ধতা বজায় থাকবে।
নিয়মিত চর্চা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব।