অনুসর্গ ও অব্যয়
বাংলা ব্যাকরণে অনুসর্গ ও অব্যয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি পদ। এদের সঠিক ব্যবহার বাক্যগঠনে যথাযথ স্পষ্টতা ও অর্থবোধকতা যোগ করে।
অনুসর্গ
📌 সংজ্ঞা:
যেসব শব্দ বাক্যের প্রধান শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, কিন্তু নিজের কোনো স্বাধীন অর্থ থাকে না, তাকে অনুসর্গ বলে। এটি মূলত বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে বসে এবং তার সঙ্গে ক্রিয়া বা বাক্যের অন্য অংশের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 রমা জন্য তুমি কষ্ট পেও না।
🔹 সে আমায় নিয়ে চলে গেল।
🔹 বাবা তোমার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।
🔹 আমার সহযোগিতায় কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
🔹 পরীক্ষার আগে ভালোভাবে প্রস্তুতি নাও।
অনুসর্গের বৈশিষ্ট্য
✔ নিজস্ব অর্থ থাকে না – এটি স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা যায় না।
✔ অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থ প্রদান করে – বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্দিষ্ট অর্থ বোঝায়।
✔ বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে – অনুসর্গ বাক্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে।
✔ অসীম ক্রিয়ার পরেও বসতে পারে – অনেক সময় ক্রিয়ার অব্যয় রূপেও এটি ব্যবহৃত হয়।
অনুসর্গের শ্রেণিবিভাগ
📌 ১. কর্মবাচক অনুসর্গ:
যেসব অনুসর্গ কোনো কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্য বা মাধ্যম বোঝায়।
✔ উদাহরণ:
🔹 সে আমার জন্য কষ্ট করেছে।
🔹 আমরা সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করি।
📌 ২. কারণবাচক অনুসর্গ:
যেসব অনুসর্গ কোনো কিছুর কারণ প্রকাশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 তার অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে।
🔹 পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত ছিলাম।
📌 ৩. উপকরণবাচক অনুসর্গ:
যেসব অনুসর্গ উপকরণ বা মাধ্যম নির্দেশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 সে কলম দিয়ে লিখছে।
🔹 কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হলো।
📌 ৪. স্থানবাচক অনুসর্গ:
যেসব অনুসর্গ স্থান নির্দেশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 সে নদীর ধারে বসে আছে।
🔹 আমরা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
📌 ৫. বিশেষ সম্পর্কসূচক অনুসর্গ:
যেসব অনুসর্গ ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ক নির্দেশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 বাবা ছেলের সহযোগিতায় কাজটি করেছেন।
🔹 শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে আলোচনা করলেন।
বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত অনুসর্গসমূহ
✔ জন্য
✔ দ্বারা
✔ মতো
✔ সাথে
✔ নিয়ে
✔ বিরুদ্ধে
✔ পরে
✔ উপর
✔ সঙ্গে
✔ দিকে
✔ মধ্যে
✔ থেকে
✔ দ্বারা
✔ পর্যন্ত
অব্যয়
📌 সংজ্ঞা:
যেসব শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হলেও কোনো পদ পরিবর্তন করে না এবং সর্বদা অপরিবর্তনীয় থাকে, তাদের অব্যয় বলে।
✔ উদাহরণ:
🔹 সে অতএব বিদায় নিল।
🔹 তুমি কিন্তু সময় মতো এসো।
🔹 সে হয়তো আসবে।
🔹 বস্তুত এটা সত্যি।
🔹 তুমি যদি যাও, আমিও যাব।
অব্যয়ের বৈশিষ্ট্য
✔ অপরিবর্তনীয় – এর লিঙ্গ, বচন, পুরুষ, কারক বা কাল পরিবর্তিত হয় না।
✔ স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহৃত হয় – এটি বাক্যের অংশ হলেও বিশেষ্য, সর্বনাম বা ক্রিয়ার মতো নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে না।
✔ বাক্যের অর্থ সুস্পষ্ট করে – বাক্যের অর্থ ও ভাব স্পষ্ট করতে সাহায্য করে।
অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ
📌 ১. অব্যয় কৃৎ (ক্রিয়াসাধক অব্যয়):
যেসব অব্যয় ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থ প্রকাশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 আমি দেখতে দেখতে চলে এলাম।
🔹 তুমি শুনে শুনে গান গাইতে পারো।
📌 ২. নিপাতন অব্যয়:
যেসব অব্যয় বাক্যে বিশেষ ভঙ্গি বা আবেগ প্রকাশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 হায় হায়! কী ভয়ানক দৃশ্য!
🔹 কি মজা! আজকের দিনটা দারুণ ছিল!
📌 ৩. সম্বন্ধসূচক অব্যয়:
যেসব অব্যয় দুটি বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 তুমি পড়াশোনা কর, নচেৎ ফেল করবে।
🔹 অতএব আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।
📌 ৪. অনুসন্ধানসূচক অব্যয়:
যেসব অব্যয় প্রশ্ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
✔ উদাহরণ:
🔹 কে আসবে আজ?
🔹 কেন এত দেরি হচ্ছে?
📌 ৫. সংশয়সূচক অব্যয়:
যেসব অব্যয় অনিশ্চয়তা বা সংশয়ের অর্থ প্রকাশ করে।
✔ উদাহরণ:
🔹 সে হয়তো আসবে না।
🔹 সম্ভবত কাল বৃষ্টি হবে।
📌 ৬. নিদেশমূলক অব্যয়:
যেসব অব্যয় আদেশ বা উপদেশ বোঝায়।
✔ উদাহরণ:
🔹 দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন।
🔹 অবশ্যই সময়মতো উপস্থিত থাকবেন।
বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত অব্যয়সমূহ
✔ তবে
✔ হয়তো
✔ কিন্তু
✔ কেন
✔ যদি
✔ তাই
✔ নচেৎ
✔ মাত্র
✔ বস্তুত
✔ যদিও
✔ অন্তত
✔ অতএব
✔ দয়া করে
অনুসর্গ ও অব্যয়ের পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | অনুসর্গ | অব্যয় |
---|---|---|
সংজ্ঞা | অন্য শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে সম্পর্ক প্রকাশ করে | বাক্যে স্থিতিশীল থেকে ভাব প্রকাশ করে |
অর্থ | নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে | বাক্যের অর্থকে আরও সুস্পষ্ট করে |
পরিবর্তনশীলতা | পরিবর্তিত হতে পারে | অপরিবর্তনীয় |
প্রয়োগ | বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে বসে | বাক্যের বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হয় |
উদাহরণ | জন্য, দ্বারা, সঙ্গে, পরে | তবে, কেন, যদি, অথচ |
উপসংহার
✔ অনুসর্গ বাক্যে বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্পর্ক প্রকাশ করে, অন্যদিকে অব্যয় বাক্যে স্থির থেকে ভাব ও সংযোগ প্রকাশ করে।
✔ বাংলা ভাষায় অনুসর্গ ও অব্যয়ের সঠিক ব্যবহার বাক্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং বাক্যকে অর্থবহ করে তোলে।
✔ এদের প্রয়োগ দক্ষভাবে শিখলে ভাষার শুদ্ধতা ও প্রকাশভঙ্গি উন্নত হয়।