অধ্যায় ৫: সন্ধি ও সন্ধির প্রকারভেদ

ভূমিকা:ভূমিকা:
বাংলা ভাষায় শব্দ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো সন্ধি। সন্ধির মাধ্যমে দুটি ধ্বনি বা শব্দ একত্রিত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি করে। এটি মূলত ধ্বনিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে এবং বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এই অধ্যায়ে আমরা সন্ধির সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, নিয়ম ও বিভিন্ন উদাহরণ বিশদভাবে আলোচনা করবো।

১. সন্ধি কী?
✅ সংজ্ঞা:
সন্ধি শব্দের অর্থ “যোগ বা মিলন”। ব্যাকরণিক অর্থে, সন্ধি হলো দুটি শব্দ বা ধ্বনির সংযোগজনিত পরিবর্তন।

📌 উদাহরণ:
1️⃣ দূর + অস্ত = দূর্যোগ
2️⃣ অতি + ইন্দ্রিয় = অতীন্দ্রিয়
3️⃣ শুভ + অশুভ = শুভাশুভ

🔹 সন্ধির বৈশিষ্ট্য:
1️⃣ সন্ধি শব্দ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম।
2️⃣ এটি উচ্চারণের সুবিধার্থে ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটায়।
3️⃣ সন্ধির ফলে নতুন শব্দ তৈরি হয় যা পৃথক শব্দের চেয়ে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে।

২. সন্ধির প্রকারভেদ
সন্ধি প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত:

1️⃣ স্বরণি সন্ধি
2️⃣ ব্যঞ্জন সন্ধি
3️⃣ বিসর্গ সন্ধি

এখন প্রতিটি সন্ধি বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

৩. স্বর সন্ধি
✅ সংজ্ঞা:
যখন দুই স্বরধ্বনি পরস্পর সংযুক্ত হয়ে উচ্চারণগত পরিবর্তন ঘটায়, তখন তাকে স্বর সন্ধি বলে।

📌 উদাহরণ:
1️⃣ কথা + আদি = কথাদি
2️⃣ অতি + উজ্জ্বল = অতিউজ্জ্বল
3️⃣ বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়

🔹 স্বর সন্ধির প্রকারভেদ:
1️⃣ অকৃৎ্ত্ব স্বর সন্ধি: ‘অ’ বা ‘আ’ যুক্ত হলে পরিবর্তন ঘটে।
যেমন:

মহা + ঋষি = মহর্ষি
দুর্গা + উৎপাত = দুর্গোৎপাত
2️⃣ গুণ সন্ধি: প্রথম শব্দের ‘এ’ বা ‘ও’ ধ্বনি দ্বিতীয় শব্দের সঙ্গে মিলিত হলে পরিবর্তন ঘটে।
যেমন:

পুন + অর্নব = পুনর্নব
দূর + অস্ত = দূর্যোগ
3️⃣ ঋত্যাদিসন্ধি: ‘ঋ’ ধ্বনি যুক্ত হলে পরিবর্তন ঘটে।
যেমন:

পরি + ঋদ্ধি = পরিবৃদ্ধি
দুর্গা + ঋতু = দুর্গার্তু
৪. ব্যঞ্জন সন্ধি
✅ সংজ্ঞা:
যখন দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি একত্রিত হয়ে উচ্চারণগত পরিবর্তন ঘটায়, তখন তাকে ব্যঞ্জন সন্ধি বলে।

📌 উদাহরণ:
1️⃣ শত + অঙ্গ = শতোঙ্গ
2️⃣ সৎ + চরিত্র = সচ্চরিত্র
3️⃣ উৎ + কর্ষ = উত্তর্ষ

🔹 ব্যঞ্জন সন্ধির প্রকারভেদ:
1️⃣ চর্ব্য সন্ধি: ‘ত’ বা ‘থ’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়।
যেমন:

উৎ + কর্ষ = উত্তর্ষ
অতিশয় + তীক্ষ্ণ = অতিশয়তীক্ষ্ণ
2️⃣ পরস্বরী সন্ধি: এক ব্যঞ্জনধ্বনি অন্য ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।
যেমন:

উৎ + গমন = উৎগমন
সৎ + গতি = সৎগতি
3️⃣ মুর্ধন্য সন্ধি: ‘ন’ বা ‘ণ’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়।
যেমন:

প্রণ + ধ্যায় = প্রণধ্যায়
তান + দ্র = তান্দ্র
৫. বিসর্গ সন্ধি
✅ সংজ্ঞা:
যখন বিসর্গ (‘ঃ’ বা ‘ঁ’) যুক্ত শব্দে ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে।

📌 উদাহরণ:
1️⃣ দুঃ + খ = দুঃখ
2️⃣ মহঃ + ইন্দ্র = মহেন্দ্র
3️⃣ বিস্ময়ঃ + কার = বিস্ময়কর

🔹 বিসর্গ সন্ধির প্রকারভেদ:
1️⃣ পরসন্ধি: বিসর্গ ‘ঃ’ পরিবর্তিত হয়ে ব্যঞ্জনে রূপান্তরিত হয়।
যেমন:

দুঃ + খ = দুঃখ
নিঃ + চেতন = নিঃচেতন
2️⃣ অপসর্গী সন্ধি: বিসর্গ ‘ঁ’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়।
যেমন:

ব্রহ্মঃ + আদি = ব্রহ্মাদি
বিস্ময়ঃ + জনক = বিস্ময়জনক
৬. সন্ধির গুরুত্ব ও প্রভাব
🔹 সন্ধি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
1️⃣ সন্ধি ভাষার শব্দ গঠনে সাহায্য করে।
2️⃣ উচ্চারণ সহজ করে এবং ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
3️⃣ শব্দের অর্থ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
4️⃣ সন্ধি জানলে বাংলা বানানের শুদ্ধতা রক্ষা করা সহজ হয়।

৭. অনুশীলনী
✅ (১) নিচের শব্দগুলোর সন্ধি বিচ্ছেদ করুন:
1️⃣ দুঃখ
2️⃣ মহর্ষি
3️⃣ বিদ্যালয়
4️⃣ উত্তর্ষ
5️⃣ পুনর্নব

✅ (২) নিচের শব্দগুলোর সন্ধি করুন:
1️⃣ শুভ + অশুভ
2️⃣ অতিশয় + তীক্ষ্ণ
3️⃣ দুঃ + খ
4️⃣ ব্রহ্মঃ + আদি
5️⃣ পরি + ঋদ্ধি

৮. উপসংহার
সন্ধি হলো বাংলা ভাষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকরণিক উপাদান। এটি শুধু শব্দ গঠনের মাধ্যম নয়, বরং ভাষার শুদ্ধতা ও শৈল্পিকতা রক্ষা করতেও সাহায্য করে। বাংলা ভাষায় তিনটি প্রধান সন্ধি রয়েছে— স্বর সন্ধি, ব্যঞ্জন সন্ধি ও বিসর্গ সন্ধি। প্রত্যেকটির নিজস্ব নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা জানা থাকলে বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা সহজ হয়।