ভূমিকা:
ভাষার মৌলিক একক হলো শব্দ। আমরা প্রতিদিন যেসব বাক্য ব্যবহার করি, সেগুলো মূলত বিভিন্ন শব্দের সমষ্টি। একটি বাক্য তৈরি করতে হলে শব্দ প্রয়োজন, আর এই শব্দগুলোর অর্থ, গঠন ও প্রয়োগ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণি থাকে। এই অধ্যায়ে আমরা শব্দের প্রকৃতি, গঠন, ব্যবহার এবং শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
১. শব্দের সংজ্ঞা
শব্দ হলো ধ্বনির একটি নির্দিষ্ট গঠন, যা নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ, কোনো ভাষার এমন একগুচ্ছ ধ্বনি বা বর্ণসমষ্টি, যা দ্বারা আমরা ভাব প্রকাশ করতে পারি, তাকে শব্দ বলে।
উদাহরণ: “বই”, “মানুষ”, “খেলা”, “তুমি”, “লিখছে”—এই শব্দগুলো দ্বারা বিভিন্ন অর্থ প্রকাশিত হয়।
২. শব্দের উৎপত্তি অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস
শব্দের উৎস কোথা থেকে এসেছে, তার ভিত্তিতে বাংলা ভাষার শব্দকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়—
(ক) তদ্ভব শব্দ
সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় প্রচলিত শব্দগুলোকে তদ্ভব শব্দ বলে।
উদাহরণ:
- গৃহ → ঘর
- পদ্ম → পদ্মা
- অঙ্গুলি → আঙুল
- জননী → জান
(খ) তৎসম শব্দ
যে শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত বা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলো তৎসম শব্দ।
উদাহরণ:
- অগ্নি, দুঃখ, অভিমান, বন্ধন, রাজা, পিতা
(গ) দেশি শব্দ
বাংলা ভাষার আদি শব্দ, যা সংস্কৃত বা বিদেশি ভাষা থেকে আসেনি, সেগুলো দেশি শব্দ বা অভ্যন্তরীণ শব্দ।
উদাহরণ:
- বউ, বোনা, মা, বাবা, ছোট, বড়
(ঘ) বিদেশি শব্দ
যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষা থেকে এসেছে, তাদের বিদেশি শব্দ বলে।
উদাহরণ:
- আরবি-ফারসি: বাজার, আদালত, জামা, কাজি
- ইংরেজি: রেল, পুলিশ, অফিস, টেলিভিশন
৩. শব্দের গঠন অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস
শব্দের গঠন ও রূপান্তরের ভিত্তিতে বাংলা শব্দকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—
(ক) মৌলিক শব্দ
যে শব্দগুলোর মধ্যে কোনো উপসর্গ বা প্রত্যয় নেই এবং যেগুলি অন্য শব্দ থেকে গঠিত হয়নি, তাদের মৌলিক শব্দ বলে।
উদাহরণ: মা, জল, পথ, আলো, আকাশ, মাটি
(খ) সাধিত শব্দ
যে শব্দে উপসর্গ বা প্রত্যয় যোগ করে নতুন শব্দ গঠিত হয়, তাকে সাধিত শব্দ বলে।
উদাহরণ:
- উপসর্গযুক্ত শব্দ: ন্যায় → অন্যায়, সুখ → অসুখ
- প্রত্যয়যুক্ত শব্দ: লেখা → লেখক, বলা → বক্তা
(গ) যৌগিক শব্দ
যে শব্দ দুটি বা ততোধিক শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি হয়, তাকে যৌগিক শব্দ বলে।
উদাহরণ:
- সমাসবদ্ধ যৌগিক শব্দ: মধুরভাষী, অন্ধকারাচ্ছন্ন
- অন্যান্য যৌগিক শব্দ: লালমুখো, বাঘমামা
৪. অর্থগত ভিত্তিতে শব্দের শ্রেণিবিভাগ
বাংলা ভাষায় শব্দের অর্থ অনুসারে এগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—
(ক) প্রকৃতার্থক শব্দ
যেসব শব্দ তাদের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলোকে প্রকৃতার্থক শব্দ বলে।
উদাহরণ:
- পাহাড় (একটি উঁচু ভূমির অংশ বোঝায়)
- নদী (প্রবাহিত জলধারা বোঝায়)
(খ) রূঢ়ার্থক শব্দ
যেসব শব্দ আক্ষরিক অর্থে কিছু বোঝায় না, বরং কিছু নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো রূঢ়ার্থক শব্দ।
উদাহরণ:
- গোলাপী → “গোলাপের মতো” নয়, বরং “একটি নির্দিষ্ট রঙ” বোঝায়।
- খোকা → “একটি নির্দিষ্ট শিশু বা ছোট ছেলে” বোঝায়।
(গ) রূপক অর্থবোধক শব্দ
যেসব শব্দ তাদের আক্ষরিক অর্থের পরিবর্তে বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো রূপক অর্থবোধক শব্দ।
উদাহরণ:
- সিংহ (আক্ষরিক অর্থে একটি জন্তু, কিন্তু রূপক অর্থে সাহসী ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহার হয়)
- কপাল পোড়া (আক্ষরিক অর্থে কপালে দাগ, কিন্তু রূপক অর্থে দুর্ভাগ্য বোঝায়)
৫. শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ
একটি ভাষার শব্দভাণ্ডার তার সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিফলন ঘটায়। বাংলা ভাষায় শব্দের ব্যবহার বিভিন্ন প্রসঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে—
(ক) সাধু ও চলিত ভাষার শব্দ
- সাধু ভাষা: তিনি গমন করিয়াছেন।
- চলিত ভাষা: তিনি গেছেন।
(খ) গ্রামীণ ও শহুরে শব্দভেদ
- গ্রামীণ: আহা, তুই কি করস?
- শহুরে: তুমি কী করছো?
(গ) শুদ্ধ ও অপশব্দ
- শুদ্ধ: বিদ্যালয়
- অপশব্দ: ইশকুল
উপসংহার:
শব্দ ভাষার মূল ভিত্তি। শব্দের সঠিক ব্যবহার এবং গঠনগত বৈচিত্র্য জানা থাকলে ভাষা আরও সুন্দর ও সাবলীল হয়। ব্যাকরণে শব্দের শ্রেণিবিন্যাস জানা থাকলে আমরা ভাষাকে আরও গঠিত ও প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ করতে পারি।
প্রশ্ন ও অনুশীলনী:
১. শব্দ কাকে বলে?
2. বাংলা ভাষার শব্দকে উৎস অনুযায়ী কয় ভাগে ভাগ করা হয়? উদাহরণসহ লিখুন।
3. মৌলিক, সাধিত ও যৌগিক শব্দের মধ্যে পার্থক্য কী?
4. প্রকৃতার্থক, রূঢ়ার্থক ও রূপক অর্থবোধক শব্দের সংজ্ঞা ও উদাহরণ লিখুন।
5. শব্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য কী?