রসায়নশাস্ত্রের অন্যতম মৌলিক ধারণা হলো পরমাণু ও অণু। প্রতিটি বস্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার দ্বারা গঠিত, যা এককভাবে পরমাণু হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে অণু তৈরি করে এবং এভাবেই বিভিন্ন পদার্থ গঠিত হয়। এই অধ্যায়ে আমরা পরমাণুর গঠন, তার সংখ্যা, রাসায়নিক প্রতীক এবং ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্ব
পরমাণু সম্পর্কে আধুনিক ধারণার ভিত্তি গড়ে উঠেছে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্বের ওপর। তিনি প্রস্তাব করেন যে সমস্ত পদার্থ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত, যা আর ভাঙা যায় না।
ডাল্টনের মূল অনুমানসমূহ
ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে রসায়নশাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
- প্রতিটি মৌল এক ধরনের পরমাণু দ্বারা গঠিত, যা অভিন্ন ভর ও ধর্মযুক্ত।
- পরমাণু অবিভাজ্য, অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে একে ছোট ছোট অংশে ভাঙা যায় না।
- রাসায়নিক বিক্রিয়া হলো পরমাণুগুলির পুনর্বিন্যাস, এতে নতুন পদার্থ সৃষ্টি হয় কিন্তু পরমাণু নষ্ট বা নতুনভাবে তৈরি হয় না।
- বিভিন্ন মৌলের পরমাণু একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট অনুপাতে যৌগ তৈরি করে।
ডাল্টনের তত্ত্ব রসায়নের ভিত্তি তৈরি করলেও আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পরমাণু বিভাজ্য এবং এতে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মতো ক্ষুদ্র কণা থাকে।
পরমাণুর গঠন
প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে একটি নিউক্লিয়াস থাকে এবং এর চারপাশে ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, যা পরমাণুর ভরের বেশিরভাগ অংশ ধারণ করে।
প্রোটন
প্রোটন হলো এক ধরনের উপপরমাণু কণা, যা নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে এবং ধনাত্মক আধান (চার্জ) বহন করে।
- প্রতিটি মৌলের পরমাণু নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটন ধারণ করে, যা তাকে সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
- প্রোটনের আধান ধনাত্মক (+1) এবং ভর প্রায় ১ অ্যাটমিক মাস ইউনিট (AMU)।
- পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা পরিবর্তিত হলে মৌল পরিবর্তিত হয়ে যায়।
নিউট্রন
নিউট্রন হলো নিউক্লিয়াসে অবস্থিত একটি উপপরমাণু কণা, যা কোনো আধান বহন করে না। এটি নিরপেক্ষ প্রকৃতির।
- নিউট্রনের ভর প্রায় ১ AMU, যা প্রোটনের সমান।
- নিউট্রনের সংখ্যা পরিবর্তিত হলে মৌলের আইসোটোপ তৈরি হয়, অর্থাৎ একই মৌল কিন্তু ভরসংখ্যা ভিন্ন হয়।
- নিউট্রন পারমাণবিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইলেকট্রন
ইলেকট্রন হলো পরমাণুর সবচেয়ে হালকা উপপরমাণু কণা, যা নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরে।
- ইলেকট্রনের আধান ঋণাত্মক (-1) এবং ভর অত্যন্ত কম (0.0005 AMU)।
- এটি বিভিন্ন শক্তিস্তরে বিভক্ত হয়ে ঘুরে, যা পরমাণুর রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে।
- ইলেকট্রনের সংখ্যা পরিবর্তিত হলে আয়ন গঠিত হয়, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মৌল ও রাসায়নিক প্রতীক
প্রত্যেক মৌলকে সহজভাবে প্রকাশ করার জন্য একটি বা দুটি অক্ষর দ্বারা তার রাসায়নিক প্রতীক নির্ধারিত হয়েছে। সাধারণত প্রতীকের প্রথম অক্ষর বড় হাতের এবং দ্বিতীয় অক্ষর থাকলে তা ছোট হাতের হয়।
রাসায়নিক প্রতীকের নিয়ম
প্রতিটি মৌলের রাসায়নিক প্রতীক নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত।
- প্রতীক সাধারণত মৌলটির ল্যাটিন বা ইংরেজি নামের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
- যেমন, হাইড্রোজেনের প্রতীক H, অক্সিজেনের O, কার্বনের C।
- যদি দুটি মৌলের নামের প্রথম অক্ষর একই হয়, তবে দ্বিতীয় অক্ষরও যোগ করা হয়, যেমন হিলিয়ামের He, ক্যালসিয়ামের Ca।
রাসায়নিক প্রতীকের গুরুত্ব
প্রতীক ব্যবহারের ফলে মৌলগুলিকে সহজে চিহ্নিত করা যায় এবং রাসায়নিক সমীকরণ লিখতে সুবিধা হয়।
- প্রতীক ব্যবহারে সময় ও স্থান বাঁচে।
- বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা সহজেই একে বুঝতে পারে।
- যৌগের গঠন বোঝাতে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পরমাণু সংখ্যা ও ভরসংখ্যা
প্রত্যেক পরমাণুর নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, যা তার রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে। পরমাণুর সংখ্যা ও ভরসংখ্যার ভিত্তিতে মৌলগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
পরমাণু সংখ্যা
পরমাণু সংখ্যা (Atomic Number) হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে উপস্থিত প্রোটনের সংখ্যা। এটি মৌলটির পরিচয় বহন করে।
- উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেনের পরমাণু সংখ্যা 1, অক্সিজেনের 8, কার্বনের 6।
- পরমাণু সংখ্যা পরিবর্তিত হলে মৌল পরিবর্তিত হয়ে যায়।
- এটি মৌলগুলির পর্যায় সারণির বিন্যাস নির্ধারণ করে।
ভরসংখ্যা
ভরসংখ্যা (Mass Number) হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে উপস্থিত প্রোটন ও নিউট্রনের সম্মিলিত সংখ্যা।
- ভরসংখ্যা = প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা।
- যেমন, কার্বনের দুটি আইসোটোপ রয়েছে—C-12 (6 প্রোটন + 6 নিউট্রন) ও C-14 (6 প্রোটন + 8 নিউট্রন)।
- মৌলের আইসোটোপ ভিন্ন ভরসংখ্যা প্রদর্শন করতে পারে, তবে তাদের রাসায়নিক ধর্ম একই থাকে।
এই অধ্যায়ে আমরা পরমাণুর গঠন, ডাল্টনের তত্ত্ব, মৌলগুলির প্রতীক এবং পরমাণু সংখ্যা ও ভরসংখ্যার ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। এই বিষয়গুলো বোঝা গেলে রসায়নের অধিকাংশ মৌলিক ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং পরবর্তী জটিল বিষয়গুলো সহজে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: পরমাণু কী?
উত্তর: পরমাণু হলো যে ক্ষুদ্রতম কণা দ্বারা পদার্থ গঠিত হয় এবং যা রাসায়নিকভাবে অবিভাজ্য।
প্রশ্ন: অণু কীভাবে গঠিত হয়?
উত্তর: বিভিন্ন পরমাণু একত্রে রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অণু তৈরি করে।
প্রশ্ন: ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্ব কী বলেছিল?
উত্তর: ডাল্টন বলেছিলেন, প্রতিটি মৌল এক ধরনের পরমাণু দ্বারা গঠিত, যা অবিভাজ্য এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পুনর্বিন্যাস হতে পারে।
প্রশ্ন: পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কী কী থাকে?
উত্তর: নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে।
প্রশ্ন: ইলেকট্রনের চার্জ কত?
উত্তর: ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক (-1)।
প্রশ্ন: প্রোটনের অবস্থান কোথায়?
উত্তর: প্রোটন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে।
প্রশ্ন: নিউট্রনের চার্জ কী?
উত্তর: নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই, এটি নিরপেক্ষ।
প্রশ্ন: পরমাণুর সংখ্যা কাকে বলে?
উত্তর: পরমাণুর নিউক্লিয়াসে উপস্থিত প্রোটন সংখ্যা পরমাণু সংখ্যা।
প্রশ্ন: ভরসংখ্যা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?
উত্তর: ভরসংখ্যা = প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা।
প্রশ্ন: মৌলগুলোর রাসায়নিক প্রতীক কেন ব্যবহৃত হয়?
উত্তর: মৌলগুলিকে সহজে প্রকাশ ও চিহ্নিত করার জন্য রাসায়নিক প্রতীক ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্ন: মৌলের রাসায়নিক প্রতীক কিভাবে নির্ধারিত হয়?
উত্তর: এটি সাধারণত মৌলের ইংরেজি বা ল্যাটিন নাম থেকে নির্ধারিত হয়।
প্রশ্ন: কার্বনের দুটি আইসোটোপের উদাহরণ কী?
উত্তর: C-12 ও C-14।
প্রশ্ন: নিউট্রন সংখ্যা পরিবর্তিত হলে কী হয়?
উত্তর: মৌলের আইসোটোপ তৈরি হয়।
প্রশ্ন: প্রোটন সংখ্যা পরিবর্তিত হলে কী ঘটে?
উত্তর: মৌল পরিবর্তিত হয়ে যায়।
প্রশ্ন: পরমাণুর সবচেয়ে হালকা উপপরমাণু কণা কোনটি?
উত্তর: ইলেকট্রন।
প্রশ্ন: ইলেকট্রনের ভর কত?
উত্তর: 0.0005 AMU।
প্রশ্ন: রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের কী ভূমিকা?
উত্তর: ইলেকট্রন আদান-প্রদানের মাধ্যমে আয়ন গঠিত হয়, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: ডাল্টনের কোন ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে?
উত্তর: পরমাণু অবিভাজ্য—এই ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্ন: পরমাণুর নিউক্লিয়াস কী করে?
উত্তর: এটি পরমাণুর ভরের বেশিরভাগ অংশ ধারণ করে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
প্রশ্ন: মৌলিক পদার্থের প্রোটন সংখ্যা কি সবসময় পরিবর্তিত হয়?
উত্তর: না, প্রোটন সংখ্যা পরিবর্তিত হলে মৌল পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২০টি মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন (MCQ)
প্রশ্ন: ডাল্টনের মতে, পরমাণু হলো—
A) বিভাজ্য কণা
B) অবিভাজ্য কণা
C) আলোক তরঙ্গ
D) ধাতব পদার্থ
সঠিক উত্তর: B) অবিভাজ্য কণা
প্রশ্ন: পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কোন কণাগুলি থাকে?
A) প্রোটন ও ইলেকট্রন
B) নিউট্রন ও ইলেকট্রন
C) প্রোটন ও নিউট্রন
D) শুধুমাত্র ইলেকট্রন
সঠিক উত্তর: C) প্রোটন ও নিউট্রন
প্রশ্ন: ইলেকট্রনের আধান কত?
A) +1
B) -1
C) 0
D) +2
সঠিক উত্তর: B) -1
প্রশ্ন: প্রোটনের ভর কত?
A) 1 AMU
B) 0.0005 AMU
C) 10 AMU
D) 2 AMU
সঠিক উত্তর: A) 1 AMU
প্রশ্ন: নিউট্রনের চার্জ কী?
A) ধনাত্মক
B) ঋণাত্মক
C) নিরপেক্ষ
D) পরিবর্তনশীল
সঠিক উত্তর: C) নিরপেক্ষ
প্রশ্ন: মৌলিক পদার্থের পরমাণু সংখ্যা কী দ্বারা নির্ধারিত হয়?
A) ইলেকট্রন সংখ্যা
B) নিউট্রন সংখ্যা
C) প্রোটন সংখ্যা
D) ভরসংখ্যা
সঠিক উত্তর: C) প্রোটন সংখ্যা
প্রশ্ন: কার্বনের দুটি আইসোটোপের মধ্যে পার্থক্য কী?
A) প্রোটন সংখ্যা ভিন্ন
B) নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন
C) ইলেকট্রন সংখ্যা ভিন্ন
D) রাসায়নিক ধর্ম ভিন্ন
সঠিক উত্তর: B) নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন
প্রশ্ন: নিচের কোনটি পরমাণুর সবচেয়ে হালকা কণা?
A) প্রোটন
B) নিউট্রন
C) ইলেকট্রন
D) পরমাণু
সঠিক উত্তর: C) ইলেকট্রন
প্রশ্ন: ভরসংখ্যা কী?
A) প্রোটন সংখ্যা + ইলেকট্রন সংখ্যা
B) প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা
C) ইলেকট্রন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা
D) শুধুমাত্র নিউট্রন সংখ্যা
সঠিক উত্তর: B) প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা
প্রশ্ন: রাসায়নিক প্রতীক ব্যবহারের প্রধান কারণ কী?
A) নাম ছোট করার জন্য
B) মৌল চিহ্নিত করার জন্য
C) পর্যায় সারণির নীতিমালা মানার জন্য
D) পরীক্ষার সুবিধার জন্য
সঠিক উত্তর: B) মৌল চিহ্নিত করার জন্য
প্রশ্ন: মৌলের রাসায়নিক প্রতীক কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়?
A) মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা
B) মৌলের ভরসংখ্যা
C) মৌলের ইংরেজি বা ল্যাটিন নাম
D) মৌলের রাসায়নিক ধর্ম
সঠিক উত্তর: C) মৌলের ইংরেজি বা ল্যাটিন নাম
প্রশ্ন: যদি কোনো পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা পরিবর্তিত হয়, তবে—
A) এটি আইসোটোপে পরিণত হয়
B) এটি অন্য মৌলে পরিণত হয়
C) এর ভরসংখ্যা পরিবর্তিত হয়
D) এর রাসায়নিক ধর্ম অপরিবর্তিত থাকে
সঠিক উত্তর: B) এটি অন্য মৌলে পরিণত হয়
প্রশ্ন: নিচের কোনটি একটি মৌল?
A) H₂O
B) CO₂
C) NaCl
D) O₂
সঠিক উত্তর: D) O₂
প্রশ্ন: নিউক্লিয়াস পরমাণুর কোথায় থাকে?
A) কেন্দ্রস্থলে
B) বাইরের কক্ষপথে
C) পরমাণুর চারপাশে
D) শুধুমাত্র ধাতব পদার্থে
সঠিক উত্তর: A) কেন্দ্রস্থলে
প্রশ্ন: আয়ন কীভাবে গঠিত হয়?
A) ইলেকট্রন হারানো বা গ্রহণের মাধ্যমে
B) নিউট্রন সংখ্যার পরিবর্তনের মাধ্যমে
C) পরমাণু সংখ্যার পরিবর্তনের মাধ্যমে
D) রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে
সঠিক উত্তর: A) ইলেকট্রন হারানো বা গ্রহণের মাধ্যমে