অধ্যায় 02 – পৃথিবীর গঠন ও গতিবিধি

পৃথিবীর আকার ও গঠন

প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত যে পৃথিবী সমতল এবং এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গেলে নিচে পড়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির ধারণা দেন। পরবর্তীতে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এবং নিউটনের মতো বিজ্ঞানীরা এই ধারণাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রমাণ করেন।

বর্তমানে এটি নিশ্চিত যে পৃথিবী পুরোপুরি গোলাকার নয়, বরং এটি ভূপৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ বল এবং নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনের কারণে একটি চ্যাপ্টা গোলক বা জিওইড আকৃতির। এটি মেরু অঞ্চলে কিছুটা চেপ্টা এবং বিষুবরেখার কাছে কিছুটা স্ফীত।

পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ১২,৭৫৬ কিলোমিটার, তবে বিষুবরেখার ব্যাস মেরু ব্যাসের তুলনায় সামান্য বেশি। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭১% জল দ্বারা আবৃত এবং বাকি অংশ স্থলভাগ। অভ্যন্তরীণ গঠনের দিক থেকে পৃথিবী মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত—ভূত্বক, ম্যান্টল ও কোর।

অভ্যন্তরীণ স্তরসমূহ (ভূত্বক, ম্যান্টল, কোর)

ভূত্বক (Crust)

ভূত্বক হল পৃথিবীর সবচেয়ে উপরের স্তর, যা তুলনামূলকভাবে পাতলা ও কঠিন। এটি দুই ধরনের হয়—মহাদেশীয় ভূত্বক এবং মহাসাগরীয় ভূত্বক।

মহাদেশীয় ভূত্বক প্রধানত গ্রানাইট দ্বারা গঠিত এবং এটি অপেক্ষাকৃত ঘনত্বহীন ও পুরু (গড়ে ৩৫-৪০ কিমি)। অন্যদিকে, মহাসাগরীয় ভূত্বক প্রধানত ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত, যা পাতলা (গড়ে ৫-১০ কিমি) হলেও অধিক ঘনত্ববিশিষ্ট।

ভূত্বকের প্রধান উপাদান হলো সিলিকা ও অ্যালুমিনিয়াম, যা “SIAL” নামে পরিচিত।

ম্যান্টল (Mantle)

ভূত্বকের নিচে ম্যান্টল স্তর অবস্থিত, যা পৃথিবীর ভর ও আয়তনের বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। এটি মূলত গলিত শিলা ও খনিজ দ্বারা গঠিত এবং এর উপাদানকে “সিমা” (Silica & Magnesium) বলা হয়।

এই স্তরের গভীরতার কারণে তাপমাত্রা ও চাপ অত্যন্ত বেশি। ম্যান্টলকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়—উপরের ম্যান্টল ও নিচের ম্যান্টল। এর উপরের অংশে একটি আংশিকভাবে গলিত স্তর থাকে, যাকে অ্যাসথেনোস্ফিয়ার বলা হয়। এই স্তর প্লেট টেকটোনিক গতিবিধির জন্য দায়ী।

কোর (Core)

পৃথিবীর সবচেয়ে অভ্যন্তরীণ স্তর হল কোর, যা প্রধানত লোহা ও নিকেলের সমন্বয়ে গঠিত। এটি দুটি অংশে বিভক্ত—বহিঃকোর ও অভ্যন্তরীণ কোর।

বহিঃকোর তরল অবস্থায় থাকে এবং পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরির জন্য দায়ী। অভ্যন্তরীণ কোর কঠিন এবং প্রচণ্ড উচ্চচাপে অবস্থিত। কোরের তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০-৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি।

মহাদেশীয় প্রবাহ ও প্লেট টেকটোনিক্স

ভূত্বক ও উপরের ম্যান্টল একসঙ্গে লিথোস্ফিয়ার গঠন করে, যা একাধিক বিশাল টেকটোনিক প্লেট দ্বারা গঠিত। এই প্লেটগুলো অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের উপরে ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করে।

এই গতিবিধির কারণেই পৃথিবীর ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে, যেমন—পর্বতের সৃষ্টি, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ এবং মহাদেশের সরণ।

জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েজেনার ১৯১২ সালে মহাদেশীয় প্রবাহ (Continental Drift) তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেন, একসময় পৃথিবীর সব মহাদেশ একসঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এটি “প্যাঞ্জিয়া” নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এটি ভেঙে বর্তমান মহাদেশসমূহ গঠিত হয়।

পরবর্তীতে প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্বের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় যে এই প্লেটগুলোর গতি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপের কারণে ঘটে। প্লেটগুলোর তিনটি প্রধান প্রকারের গতিবিধি রয়েছে—

  • বিচ্ছিন্ন সীমানা (Divergent Boundary): দুটি প্লেট বিপরীত দিকে সরলে নতুন ভূত্বকের সৃষ্টি হয়, যেমন মধ্য-আটলান্টিক রিজ।
  • সংকোচন সীমানা (Convergent Boundary): দুটি প্লেট পরস্পরের দিকে এগোলে একটির উপর অন্যটি উঠে যায়, যা পর্বত ও আগ্নেয়গিরি তৈরি করতে পারে।
  • রূপান্তর সীমানা (Transform Boundary): দুটি প্লেট পরস্পরের পাশ দিয়ে সরে গেলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়, যেমন সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট।

ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি

ভূমিকম্প

ভূমিকম্প হল ভূত্বকের অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে ভূ-পৃষ্ঠের আকস্মিক কম্পন। এটি প্রধানত প্লেট টেকটোনিক গতিবিধি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ভূগর্ভস্থ চাপ বৃদ্ধির কারণে ঘটে।

ভূমিকম্পের প্রধান উপাদান—

  • কেন্দ্রবিন্দু (Focus): ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভূগর্ভে অবস্থিত।
  • উপকেন্দ্র (Epicenter): কেন্দ্রবিন্দুর ঠিক উল্টো ভূ-পৃষ্ঠের বিন্দু যেখানে ভূমিকম্পের কম্পন সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়।
  • সিসমিক তরঙ্গ: ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ যা ভূপৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি করে।

ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য রিখটার স্কেল ও মোডিফাইড মারকেলি স্কেল ব্যবহার করা হয়।

আগ্নেয়গিরি

আগ্নেয়গিরি হল ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত গলিত শিলা, গ্যাস ও ধাতব পদার্থের ভূ-পৃষ্ঠে নির্গমনের প্রক্রিয়া। এটি প্রধানত ভূত্বকের দুর্বল অঞ্চলে ঘটে এবং প্লেট টেকটোনিক গতিবিধির সাথে সম্পর্কিত।

আগ্নেয়গিরির প্রধান ধরণসমূহ—

  • সক্রিয় আগ্নেয়গিরি: যেগুলো নিয়মিত অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়, যেমন ইতালির এটনা।
  • নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি: যেগুলো দীর্ঘদিন অগ্ন্যুৎপাত করেনি, কিন্তু ভবিষ্যতে করতে পারে, যেমন ফুজিয়ামা।
  • নির্জীব আগ্নেয়গিরি: যেগুলো কখনোই পুনরায় অগ্ন্যুৎপাত ঘটাবে না, যেমন ভারতের রাজমহল আগ্নেয়গিরি।

ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির কারণে ভূগর্ভস্থ গঠনে পরিবর্তন আসে এবং এটি মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন, প্লেট টেকটোনিক গতিবিধি, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি আমাদের ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের মূল কারণ। এগুলো কেবলমাত্র বিজ্ঞান ও গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং মানুষের নিরাপত্তা, নগর পরিকল্পনা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও ভূমিকা রাখে।


প্রশ্ন: প্রাচীনকালে মানুষ পৃথিবীর আকার সম্পর্কে কী ধারণা করত?
উত্তর: তারা বিশ্বাস করত যে পৃথিবী সমতল এবং এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গেলে নিচে পড়ে যাওয়া সম্ভব।

প্রশ্ন: পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির ধারণা প্রথম কে দেন?
উত্তর: গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা।

প্রশ্ন: পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি কী?
উত্তর: পৃথিবী সম্পূর্ণ গোলাকার নয়, এটি “জিওইড” আকৃতির, যা মেরু অঞ্চলে কিছুটা চেপ্টা ও বিষুবরেখার কাছে কিছুটা স্ফীত।

প্রশ্ন: পৃথিবীর গড় ব্যাস কত?
উত্তর: প্রায় ১২,৭৫৬ কিলোমিটার।

প্রশ্ন: পৃথিবীর কত শতাংশ জল দ্বারা আবৃত?
উত্তর: প্রায় ৭১%।

প্রশ্ন: পৃথিবীর প্রধান অভ্যন্তরীণ স্তর কয়টি এবং কী কী?
উত্তর: তিনটি—ভূত্বক, ম্যান্টল ও কোর।

প্রশ্ন: ভূত্বক কত প্রকারের হয়?
উত্তর: দুই প্রকার—মহাদেশীয় ভূত্বক ও মহাসাগরীয় ভূত্বক।

প্রশ্ন: মহাদেশীয় ভূত্বকের প্রধান উপাদান কী?
উত্তর: গ্রানাইট।

প্রশ্ন: মহাসাগরীয় ভূত্বকের প্রধান উপাদান কী?
উত্তর: ব্যাসল্ট।

প্রশ্ন: ভূত্বকের প্রধান উপাদান কী কী?
উত্তর: সিলিকা ও অ্যালুমিনিয়াম, যা “SIAL” নামে পরিচিত।

প্রশ্ন: ম্যান্টলের উপাদান কী?
উত্তর: সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম, যা “SIMA” নামে পরিচিত।

প্রশ্ন: অ্যাসথেনোস্ফিয়ার কী?
উত্তর: ম্যান্টলের উপরের একটি আংশিকভাবে গলিত স্তর, যা প্লেট টেকটোনিক গতিবিধির জন্য দায়ী।

প্রশ্ন: কোরের প্রধান উপাদান কী?
উত্তর: লোহা ও নিকেল।

প্রশ্ন: পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরির জন্য কোন স্তর দায়ী?
উত্তর: বহিঃকোর।

প্রশ্ন: মহাদেশীয় প্রবাহ তত্ত্ব প্রথম কে প্রস্তাব করেন?
উত্তর: আলফ্রেড ওয়েজেনার (১৯১২ সালে)।

প্রশ্ন: প্লেট টেকটোনিক্স কী?
উত্তর: এটি এমন একটি তত্ত্ব যা বলে যে পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার বিভিন্ন প্লেট দ্বারা গঠিত এবং এগুলো ধীরে ধীরে সরে যায়।

প্রশ্ন: ভূমিকম্প কীভাবে সৃষ্টি হয়?
উত্তর: প্লেট টেকটোনিক গতিবিধি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ভূগর্ভস্থ চাপ বৃদ্ধির কারণে ভূমিকম্প ঘটে।

প্রশ্ন: ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু কী?
উত্তর: ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, যা ভূগর্ভে অবস্থিত।

প্রশ্ন: সক্রিয় আগ্নেয়গিরির উদাহরণ কী?
উত্তর: ইতালির এটনা।

প্রশ্ন: প্লেট টেকটোনিক গতির কয়টি প্রধান ধরন রয়েছে?
উত্তর: তিনটি—বিচ্ছিন্ন সীমানা, সংকোচন সীমানা ও রূপান্তর সীমানা।


1 / 20

কোন প্লেট সীমানায় পর্বতের সৃষ্টি হয়?

2 / 20

প্রাচীনকালে মানুষ পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে কী ধারণা করত?

3 / 20

মহাদেশীয় প্রবাহ তত্ত্ব অনুসারে একসময়ের একক মহাদেশের নাম কী ছিল?

4 / 20

ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য কোন স্কেল ব্যবহার করা হয়?

5 / 20

কোন স্তর প্লেট টেকটোনিক গতিবিধির জন্য দায়ী?

6 / 20

ম্যান্টলের প্রধান উপাদান কী?

7 / 20

ভারতের রাজমহল আগ্নেয়গিরির বর্তমান অবস্থা কী?

8 / 20

পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি কী?

9 / 20

রূপান্তর সীমানার ফলে কী ঘটে?

10 / 20

পৃথিবীর পৃষ্ঠের কত শতাংশ জল দ্বারা আবৃত?

11 / 20

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ স্তর কয়টি?

12 / 20

প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্বের প্রধান কারণ কী?

13 / 20

পৃথিবীর গড় ব্যাস কত?

14 / 20

পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরির জন্য দায়ী স্তর কোনটি?

15 / 20

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলকে কী বলা হয়?

16 / 20

গ্রিক বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে কী ধারণা দেন?

17 / 20

মহাদেশীয় প্রবাহ তত্ত্ব কে প্রস্তাব করেন?

18 / 20

পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির একটি হলো—

19 / 20

ভূমিকম্পের ফলে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাকে কী বলা হয়?

20 / 20

ভূত্বক কী দ্বারা গঠিত?

Your score is

The average score is 13%

0%