অধ্যায় ২৪: অপশব্দ ও মানসম্মত ভাষা ব্যবহারের নিয়ম

ভূমিকা

ভাষা মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু সঠিক শব্দের নির্বাচন ও ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, এটি একজন ব্যক্তির রুচি, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের প্রতিফলনও ঘটায়।

আমাদের ভাষার ব্যবহারে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ – শালীনতা ও শুদ্ধতা। কিন্তু অনেক সময় আমরা না বুঝেই অপশব্দ বা অশালীন শব্দ ব্যবহার করি, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সুন্দর ও মানসম্মত ভাষা ব্যবহারের নিয়ম জানা অত্যন্ত জরুরি।


অপশব্দ কী?

🔹 অপশব্দ হল এমন শব্দ বা বাক্য, যা সামাজিক ও ভাষাগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং শ্রুতিমধুরও নয়। এটি কুরুচিপূর্ণ, আক্রমণাত্মক, নোংরা, কিংবা অসম্মানসূচক হতে পারে।

📌 উদাহরণ:

  • অশ্রদ্ধাসূচক শব্দ – বোকা, নির্বোধ, গাধা, খেঁকুরে
  • অশ্লীল শব্দ – নোংরা গালি, বাজে মন্তব্য
  • অশালীন ভাষা – অন্যকে হেয় করে বলা কথা
  • অমার্জিত বা দুর্ব্যবহারসূচক শব্দ – হঠাৎ রেগে গিয়ে কাউকে অসম্মান করে কিছু বলা

🔹 এই ধরনের শব্দ ব্যবহারের ফলে সামাজিক সম্পর্কের অবনতি হয়, ব্যক্তি সম্মানহানি ঘটে, এবং ভাষার মান নষ্ট হয়।


অপশব্দের প্রভাব

ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটে – অপশব্দ ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়।
সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হয় – সমাজে শৃঙ্খলা ও সম্মানের পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভাষার মর্যাদা হ্রাস পায় – একসময় এই শব্দগুলো দৈনন্দিন ভাষায় প্রবেশ করে ভাষার মান নিচে নামিয়ে আনে।
মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় – অনাকাঙ্ক্ষিত অপমান বা কটূক্তি অনেক সময় মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে – পেশাদার জীবনে অশালীন ভাষার কারণে সম্মান হারানোর ঝুঁকি থাকে।


কীভাবে অপশব্দের ব্যবহার এড়িয়ে চলবেন?

১. সংযম বজায় রাখা ও ভদ্রতা শেখা
কোনো পরিস্থিতিতেই উত্তেজিত হয়ে অপমানজনক বা গালিসূচক ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়। রাগ বা হতাশার সময় সংযতভাবে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

২. সুন্দর ভাষার চর্চা করা
শুদ্ধ, প্রাঞ্জল ও মার্জিত ভাষার চর্চা করতে হবে। সাহিত্য, ভালো বই, সংবাদপত্র ও ভাষা উন্নতকারী উপকরণ পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

৩. ইতিবাচক ও শালীন শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করা
“বোকা” না বলে “অভিজ্ঞতা অর্জন করো” বলা যেতে পারে।
“তুমি কিছুই পারো না” বলার পরিবর্তে “পরিশ্রম করলে তুমি আরও ভালো করতে পারবে” বলা যেতে পারে।

৪. শিশুকে শুরু থেকেই সুন্দর ভাষা শেখানো
ছোটবেলা থেকেই যদি শিশুদের সুন্দর ভাষার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়, তবে তারা ভবিষ্যতে অপশব্দের ব্যবহার কম করবে।

৫. উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে অনুপ্রাণিত করা
যারা বেশি অপশব্দ ব্যবহার করে, তাদেরকে সুন্দর ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবক এবং সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।

৬. কর্মক্ষেত্রে ও পেশাদার জীবনে শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা
প্রতিষ্ঠানে, অফিসে, শিক্ষাক্ষেত্রে, সভা-সমিতিতে সবসময় সুশৃঙ্খল ও শালীন ভাষার ব্যবহার করতে হবে।


মানসম্মত ভাষা ব্যবহারের নিয়ম

🔹 শুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যাকরণের ব্যবহার
সঠিক উচ্চারণ এবং ব্যাকরণ অনুযায়ী ভাষা প্রয়োগ করা উচিত।

🔹 কোনো শব্দের অর্থ না জেনে ব্যবহার না করা
অনেক সময় আমরা না বুঝেই কিছু শব্দ ব্যবহার করি, যা ভুল অর্থ প্রকাশ করতে পারে।

🔹 সাহিত্য ও প্রাঞ্জল ভাষার চর্চা করা
ভালো গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সংবাদ ও গবেষণাধর্মী লেখা পড়লে ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

🔹 অশ্রদ্ধাসূচক শব্দ পরিহার করা
কারও প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকলেও, তা প্রকাশের সময় শালীন ভাষা ব্যবহার করা উচিত।

🔹 অশ্লীল বা ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক শব্দ এড়িয়ে চলা
কোনো আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের সময় কটূক্তি বা গালাগালি করা কখনোই উচিত নয়।


মানসম্মত ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব

ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন ঘটে – মার্জিত ভাষা ব্যবহারে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সম্মান বৃদ্ধি পায়।
সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় – সমাজে সৌহার্দ্য ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
শিক্ষা ও পেশাদার জীবনে উন্নতি হয় – সুন্দর ও সঠিক ভাষার প্রয়োগ কর্মজীবনে সুযোগ এনে দেয়।
পরিবার ও সমাজে সম্পর্ক দৃঢ় হয় – ভদ্র ভাষা ব্যবহারের ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।
ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় – আমাদের বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।


উপসংহার

অপশব্দ ও অশালীন ভাষার ব্যবহার ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সঠিক শব্দচয়ন, মার্জিত ভাষার চর্চা, শুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যাকরণের অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি।

সুন্দর ও শালীন ভাষার চর্চা করলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, সামাজিক মূল্যবোধ দৃঢ় হয় এবং সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়। তাই, প্রতিদিনের জীবনে অপশব্দ পরিহার করে শুদ্ধ, প্রাঞ্জল ও সম্মানজনক ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।