অধ্যায় ৬: সমাস ও সমাসের শ্রেণিবিভাগ

সমাস ও সমাসের শ্রেণিবিভাগ

সমাস বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকরণিক উপাদান, যা শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত দুটি বা ততোধিক শব্দের সংক্ষেপিত রূপ, যেখানে তাদের মধ্যে ব্যবহৃত বিভক্তি বা অব্যয় লোপ পায় এবং নতুন শব্দ তৈরি হয়। এই নতুন শব্দটি আগের পৃথক শব্দগুলোর অর্থের সমন্বয়ে গঠিত হয়।

সমাসের সংজ্ঞা:
সমাস শব্দের অর্থ সংক্ষেপ বা মিলন। ব্যাকরণিক অর্থে, দুটি বা ততোধিক পদের মধ্যে ব্যবহৃত বিভক্তি বা অব্যয় লোপ পেয়ে যখন একটি নতুন শব্দ গঠিত হয়, তখন তাকে সমাস বলে।

📌 উদাহরণ:
✔ চন্দ্র + মণ্ডল = চন্দ্রমণ্ডল
✔ গুরু + গৃহ = গুরুগৃহ
✔ রাজা + পুরুষ = রাজপুরুষ

সমাস বাংলা ভাষাকে সংক্ষিপ্ত, অর্থবহ ও সুগঠিত করতে সাহায্য করে। এটি বাক্যগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং ভাষার শৈল্পিকতা বৃদ্ধি করে।

সমাসের বৈশিষ্ট্য
✔ দুটি বা ততোধিক শব্দের সংযোজনের মাধ্যমে সমাস গঠিত হয়।
✔ সংযুক্ত শব্দগুলোর মাঝে বিভক্তি বা অব্যয় লোপ পায়।
✔ নতুন শব্দটি আগের শব্দগুলোর অর্থের সমন্বয়ে তৈরি হয়।
✔ নতুন শব্দটি সংক্ষিপ্ত হলেও তার অর্থ সুস্পষ্ট হয়।

সমাসের শ্রেণিবিভাগ
সমাসকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়:

✔ অব্যয়ীভাব সমাস
✔ তৎপুরুষ সমাস
✔ দ্বন্দ্ব সমাস
✔ দ্বিগু সমাস
✔ বহুব্রীহি সমাস

অব্যয়ীভাব সমাস
যে সমাসে প্রথম পদটি অব্যয় থাকে এবং সমগ্র শব্দটি একটি বিশেষ অব্যয় বা বিশেষণ অর্থ প্রকাশ করে, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে।

📌 উদাহরণ:
✔ অতী + দ্রুত = অতিদ্রুত (অতিরিক্ত দ্রুত)
✔ সহ + কর = সহযোগ (সহযোগিতা করা)
✔ নিঃ + শব্দ = নীরব (শব্দহীন)

এ ধরনের সমাসের ক্ষেত্রে মূলত অব্যয় শব্দগুলোর সঙ্গে অন্য শব্দ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে।

তৎপুরুষ সমাস
যে সমাসে পরের শব্দ প্রধান এবং প্রথম শব্দ তার ব্যাখ্যা করে, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। এখানে সাধারণত বিভক্তি লোপ পায়।

📌 উদাহরণ:
✔ দেশের + প্রেম = দেশপ্রেম (দেশের প্রতি প্রেম)
✔ গুরু + শিষ্য = গুরুশিষ্য (গুরু ও শিষ্য)
✔ কার্যের + ফল = কার্যফল (কার্যের ফল)

তৎপুরুষ সমাসকে আবার পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়:

1️⃣ কর্মধারয় সমাস: যেখানে উভয় শব্দই সমানভাবে বিশেষণ বোঝায়।
✔ নীল + আকাশ = নীলাকাশ
✔ মহা + পুরুষ = মহাপুরুষ

2️⃣ দ্বিতীয়া তৎপুরুষ: যেখানে দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ পায়।
✔ গ্রহণ + কর = গ্রহণকারি
✔ বিদ্যা + লাভ = বিদ্যালাভ

3️⃣ তৃতীয়া তৎপুরুষ: যেখানে তৃতীয়া বিভক্তি লোপ পায়।
✔ কলম + দ্বারা = কলমদ্বারা
✔ শক্তি + সঙ্গে = শক্তিসহ

4️⃣ চতুর্থী তৎপুরুষ: যেখানে চতুর্থী বিভক্তি লোপ পায়।
✔ জন + জন্য = জনগণ
✔ উপকার + জন্য = উপকারার্থ

5️⃣ ষষ্ঠী তৎপুরুষ: যেখানে ষষ্ঠী বিভক্তি লোপ পায়।
✔ পিতার + আদেশ = পিতৃআদেশ
✔ বৃক্ষের + ছায়া = বৃক্ষছায়া

দ্বন্দ্ব সমাস
যে সমাসে দুই বা ততোধিক শব্দ একই গুরুত্ব বহন করে এবং কোনো শব্দ অপর শব্দের উপর নির্ভরশীল নয়, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।

📌 উদাহরণ:
✔ রাজা + প্রজা = রাজাপ্রজা (রাজা ও প্রজা)
✔ পিতা + মাতা = পিতামাতা (পিতা ও মাতা)
✔ দিন + রাত = দিনরাত (দিন ও রাত)

এক্ষেত্রে, উভয় শব্দই সমানভাবে গুরুত্ব বহন করে এবং উভয়ের অস্তিত্ব বজায় থাকে।

দ্বিগু সমাস
যে সমাসে সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দ যুক্ত হয় এবং একসঙ্গে একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তাকে দ্বিগু সমাস বলে।

📌 উদাহরণ:
✔ দুই + চক্ষু = দ্বিচক্ষু (দুটি চোখবিশিষ্ট)
✔ চতুর + বাহু = চতুর্বাহু (চার বাহু বিশিষ্ট)
✔ পঞ্চ + বটী = পঞ্চবটী (পাঁচটি বটগাছের সমষ্টি)

দ্বিগু সমাস সাধারণত সংখ্যা নির্দেশক শব্দ থেকে গঠিত হয় এবং বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে।

বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসে কোনো পদই প্রধান নয়, বরং পুরো শব্দটি মিলে কোনো ব্যক্তির বা বস্তুর নাম বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।

📌 উদাহরণ:
✔ নগর + রাজ = নাগরাজ (যে নাগরাজ)
✔ চক্র + পাণি = চক্রপাণি (যার হাতে চক্র আছে)
✔ অন্ন + পথ = অন্নপথ (যে খাদ্যের পথিক)

বহুব্রীহি সমাসে মূল শব্দগুলো আলাদা অর্থ বোঝায় না, বরং নতুন একটি অর্থ প্রকাশ করে।

সমাসের গুরুত্ব
✔ বাংলা ভাষাকে সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর করতে সাহায্য করে।
✔ উচ্চারণ সহজতর হয় এবং বাক্যকে সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহ করে তোলে।
✔ সাহিত্য, কবিতা ও আনুষ্ঠানিক ভাষায় সমাসের ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
✔ বিভিন্ন শব্দের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থের গভীরতা বৃদ্ধি করে।

অনুশীলনী
✔ (১) নিচের শব্দগুলোর সমাস বিচ্ছেদ করুন:
1️⃣ পিতামাতা
2️⃣ মহাপুরুষ
3️⃣ অন্নপথ
4️⃣ রাজপুত্র
5️⃣ দিনরাত

✔ (২) নিচের শব্দগুলোর সমাস করুন:
1️⃣ বাবা + মা
2️⃣ নগর + রাজ
3️⃣ সহ + কর
4️⃣ দুই + বাহু
5️⃣ গুরু + গৃহ

উপসংহার
সমাস বাংলা ব্যাকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বাক্যের গঠনকে সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহ করে তোলে। বাংলা ভাষায় সমাসের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, প্রতিটির আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং ব্যাকরণিক গুরুত্ব আছে। ভাষার শুদ্ধতা ও শৈল্পিকতা বজায় রাখতে সমাসের নিয়ম জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।