অধ্যায় ২: বর্ণ ও ধ্বনি বিশ্লেষণ

ভূমিকা:

যেকোনো ভাষার মূল ভিত্তি হলো বর্ণ ও ধ্বনি। আমরা যে শব্দ উচ্চারণ করি, তা মূলত ধ্বনির সমষ্টি। এই ধ্বনিগুলো যখন নির্দিষ্ট আকারে লিখিত হয়, তখন সেগুলোকে বর্ণ বলা হয়। ভাষাকে সঠিকভাবে উচ্চারণ ও লিখতে হলে বর্ণ ও ধ্বনির প্রাথমিক জ্ঞান থাকা জরুরি।


১. বাংলা ভাষার বর্ণমালা

বাংলা ভাষার লিখিত রূপকে বাংলা লিপি বলা হয়। বাংলা ভাষার বর্ণমালা দেবনাগরী লিপি থেকে উদ্ভূত। বাংলা ভাষার বর্ণমালায় মোট ৫০টি বর্ণ আছে।

বাংলা বর্ণমালার শ্রেণিবিন্যাস:

বাংলা বর্ণমালা প্রধানত দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত—

ক. স্বরবর্ণ (১১টি)

যে বর্ণ উচ্চারণের জন্য অন্য কোনো ধ্বনির সাহায্য লাগে না, তাকে স্বরবর্ণ বলে। বাংলা ভাষায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে—

স্বরবর্ণ

স্বরবর্ণের প্রকারভেদ:

১. হ্রস্ব স্বরবর্ণ – অ, ই, উ, ঋ
2. দীর্ঘ স্বরবর্ণ – আ, ঈ, ঊ
3. যৌগিক স্বরবর্ণ – এ, ঐ, ও, ঔ

খ. ব্যঞ্জনবর্ণ (৩৯টি)

যে বর্ণ স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া একা উচ্চারিত হতে পারে না, তাকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। বাংলা ভাষায় ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ আছে—

গুটিকয়েক ব্যঞ্জনবর্ণ
বাকিগুলোও অনুরূপভাবে সাজানো থাকবে।

২. ধ্বনি কী?

আমরা যখন কোনো শব্দ উচ্চারণ করি, তখন মুখ থেকে নির্গত শব্দতরঙ্গকে ধ্বনি বলে।

বাংলা ধ্বনির প্রকারভেদ:

বাংলা ভাষার ধ্বনি মূলত তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত—

ক. স্বরধ্বনি

এটি এমন ধ্বনি, যা স্বরযন্ত্র থেকে কোনো বাধা ছাড়াই উচ্চারিত হয়। বাংলা ভাষার ১১টি স্বরবর্ণ স্বরধ্বনির অন্তর্ভুক্ত।

খ. ব্যঞ্জনধ্বনি

এটি এমন ধ্বনি, যা উচ্চারণ করতে গিয়ে মুখের কোনো না কোনো অংশে বাধা সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যঞ্জনধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত।

গ. অর্ধধ্বনি বা যুক্তধ্বনি

যখন দুটি ধ্বনি একসঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন একটি ধ্বনি তৈরি করে, তখন তাকে যুক্তধ্বনি বলা হয়। যেমন— ক্ত, দ্ধ, ষ্ণ, ত্ম, স্থ, ইত্যাদি।


৩. বাংলা ধ্বনির শ্রেণিবিন্যাস:

বাংলা ধ্বনিকে উচ্চারণের স্থান ও পদ্ধতির ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—

(ক) উচ্চারণের স্থানের ভিত্তিতে ধ্বনি শ্রেণিবিন্যাস

প্রকারউচ্চারণস্থলউদাহরণ
ওষ্ঠ্য ধ্বনিওষ্ঠ বা ঠোঁটপ, ফ, ব, ভ, ম
দন্ত্য ধ্বনিদাঁতের সাহায্যেত, থ, দ, ধ, ন
মূর্ধন্য ধ্বনিজিহ্বার আগা উঁচিয়ে উচ্চারণট, ঠ, ড, ঢ, ণ
তালব্য ধ্বনিতালুতে জিহ্বার স্পর্শ হয়চ, ছ, জ, ঝ, ঞ
কণ্ঠ্য ধ্বনিগলার ভেতরের অংশে উচ্চারিতক, খ, গ, ঘ, ঙ

(খ) উচ্চারণের পদ্ধতির ভিত্তিতে ধ্বনি শ্রেণিবিন্যাস

প্রকারউদাহরণ
অঘোষ ধ্বনিক, খ, ট, ঠ, প, ফ, চ, ছ
ঘোষ ধ্বনিগ, ঘ, ড, ঢ, দ, ধ, ব, ভ, জ, ঝ
নাসিক্য ধ্বনিঙ, ঞ, ণ, ন, ম
অন্তঃস্থ ধ্বনিয, র, ল, ড়

৪. বাংলা বর্ণ ও ধ্বনির সম্পর্ক

বর্ণ হল ধ্বনির লিখিত প্রতিরূপ। ধ্বনির সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে ভাষা শুদ্ধ ও সুস্পষ্ট হয়। বাংলা ভাষায় কিছু ধ্বনির উচ্চারণ বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তিত হয়, যা উচ্চারণগত বৈচিত্র্য তৈরি করে।


৫. যুক্তবর্ণ ও সংযুক্ত বর্ণ

যুক্তবর্ণ:

দুটি বা ততোধিক ব্যঞ্জনবর্ণ একত্রে মিশে নতুন একটি প্রতীক তৈরি করলে তাকে যুক্তবর্ণ বলে। যেমন— ক্ত, ঞ্জ, ষ্ণ, দ্ধ, ইত্যাদি।

সংযুক্ত বর্ণ:

কিছু ক্ষেত্রে ব্যঞ্জনবর্ণ দুটি পাশাপাশি থাকলেও তাদের পৃথকভাবে উচ্চারণ করা যায়, সেটিকে সংযুক্ত বর্ণ বলে। যেমন— হরফ, অধ্যাপক।


উপসংহার:

বর্ণ ও ধ্বনি বাংলা ভাষার মূল কাঠামো গঠন করে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার ও উচ্চারণ জানা থাকলে ভাষা আরও শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল হয়। তাই, বাংলা ব্যাকরণ শেখার প্রথম ধাপ হিসেবে বর্ণ ও ধ্বনি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা আবশ্যক।


প্রশ্ন ও অনুশীলনী:

১. বাংলা ভাষায় মোট কতটি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আছে?
2. ধ্বনি কী? ধ্বনির প্রধান কতটি শ্রেণি আছে?
3. স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির পার্থক্য কী?
4. উচ্চারণের স্থানের ভিত্তিতে ধ্বনির শ্রেণিবিন্যাস কীভাবে করা হয়?
5. যুক্তবর্ণ ও সংযুক্ত বর্ণের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করো।